আবারও অশ্বত্থামা



গত ২৭ এ মে কেরালার পালাক্কাড়ে গর্ভবতী হাতির বিস্ফোরক সমেত একটি ফল খাওয়ার ফলে তার গর্ভস্থ সন্তানের সাথে মৃত্যুর খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলে। ঘটনাটি প্রথমদিকে কীভাবে রিপোর্ট করা হয়, কীভাবে সেই রিপোর্টের প্রতিটা দিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং অনেকগুলো দিক মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তা বর্তমান ভারতে মিডিয়ার ভূমিকা এবং ভারতীয়রা কীভাবে মিডিয়া থেকে তথ্য পান সে সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ চিত্র সামনে তুলে ধরে। এনডিটিভি রিপোর্টার শৈলজা ভার্মা একটি প্রতিবেদনে তিনটি ভুল করেছিলেন: (১) তিনি ভুল জেলার নাম রিপোর্ট করেন, পালাক্কাড়ের পরিবর্তে মালাপ্পুরাম, (২) তিনি ভুল ফলের নাম রিপোর্ট করেন, নারকেলের পরিবর্তে আনারস এবং অবশেষে (৩) তিনি বলেছিলেন যে হাতিটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে মারাত্মক ফল খাওয়ানো হয়েছিল যা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। আসুন দেখে নি কীভাবে এই প্রতিটি মিথ্যা বা অর্ধ-সত্যকে কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ।

ভার্মা ইতিমধ্যে একটি ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন


মালাপ্পুরাম কেরালার একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা, এবং বিজেপির ট্রোলবৃন্দ এই ভুল রিপোর্ট এর সাহায্যে মুসলমানদের হাতি জবাইকারী বানিয়ে হিন্দু-নৈতিকতার পাঠ পড়ানোর এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। শীঘ্রই কানাঘুষো চলতে থাকে যে আমজাথ আলী ও থামিম শেখ নামের দুই মুসলমান ব্যক্তি হাতিটির মৃত্যুর জন্য দায়ী । অথচ বিভাগীয় বনদপ্তর অফিসার কে. সুনীল কুমার জানান যে মাল্লাপ্পুরাম নয়, বরং পালাক্কাড় জেলার মান্নারক্কাড় বিভাগে হাতিটি মারা গিয়েছিল। পালাক্কাড়ের পুলিশ সুপার জি শিব বিক্রম জানিয়েছেন যে পি পি উইলসন নামের এক স্থানীয় রাবার রোপনকারী শ্রমিককে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও আরও দু'জন সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, যাদের কারুর ই নাম আমজাথ আলী বা থামিম শেখ নয়।

দিল্লি হাইকোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত প্যাটেল উমরাও 

১৪৪ টি অক্ষরে নিজের ধর্মান্ধতার প্রকৃত পরিচয় দিলেন


               প্রশান্ত প্যাটেল উমরাও

               ছবির উৎস:: The Quint


কে. সুনীল কুমার আরও স্পষ্ট করে জানান হাতিটি যে আনারস খেয়েছিল এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। সম্পর্কিত বন বিভাগের তদন্তকারী কর্মকর্তা ইউ. আশিক আলির মতে, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণগুলি ইঙ্গিত দিয়েছে যে হাতিটি আসলে একটি বিস্ফোরক ভর্তি নারকেল গিলে নিয়েছিল যা আসলে বুনো শুয়োরের মতো অধিক্রমনকারী প্রজাতি তাড়ানোর জন্য রাখা ছিল। এর থেকে স্পষ্ট যে ইচ্ছাকৃত ভাবে হাতিটিকে মেরে ফেলা হয়নি। স্পষ্টতই কোনও বুনো হাতির কাছাকাছি গিয়ে তাকে খাওয়ানো অত্যন্ত বিপজ্জনক, এবং সুনীল কুমার মনে করেন যে স্থানীয়রা সেটা আমাদের থেকে অনেক ভাল জানেন। বুনো শুয়োর বরাবরি কেরালায় ফসল ধ্বংস করে, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে আবাদী জমি থেকে এই প্রাণীগুলিকে দূরে রাখার উপায়ের অভাবের কারণে কৃষকদের বিস্ফোরক ব্যবহারের রাস্তা নিতে হয়।

আমরা এতক্ষন "কীভাবে" ঘটনার ক্রনোলজি (ঘটনাক্রম) এগিয়েছে সেটা জানলাম, আসুন এবার আমরা "কেন"র উত্তরের খোঁজ করি। কেরালা হল ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে একটি যেখানে, কোভিড -১৯-এর (করোনার) বিস্তার সবচেয়ে সফলভাবে আটকানো গেছে, যা অর্ণব গোস্বামীর মতো ডানপন্থী মুখপত্রগুলির দ্বারাও স্বীকৃত। ডানপন্থী শিবিরে কমিউনিস্ট শাসিত রাজ্যের সর্বক্ষণ দুর্নাম করার পন্থার প্রতি এটি ছিল এক অপ্রত্যাশিত বাধা। তবে হাতির মৃত্যুর এই খবর তাদেরকে কেরালার বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় না রাখার, ভারতীয় নীতিবোধের বিরুদ্ধে যাওয়ার একটি নতুন অপপ্রচার শুরু করতে সহায়তা করেছিল। এই অপপ্রচারের প্রধান কৌশল ছিল এটি একটি আপাতভাবে অরাজনৈতিক গল্পের মোড়কে একটি গোটা জেলার বা রাজ্যের বিবেকের অভাবের প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরে। সুতরাং বেশ কিছু বকধার্মিক টুইটার সেলিব্রিটি এই অপপ্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেই তাঁরাই যাঁরা সাম্প্রতিক বাঘজান তেল খনির আগুনের মতো গুরুতর পরিবেশগত বিপর্যয়কে সুবিধামত / কৌশলগতভাবে উপেক্ষা করেছেন।


             বিরাট কোহলি,

          ভারতীয় ক্রিকেটার।

বিরাট কোহলি, দ্রুত হাতির বিষয়ে টুইট করেছিলেন তবে তিনি পদ্ধতিগত 

সমস্যাগুলি নিয়ে টুইট করার থেকে এখনও (২৬ শে জুন ২০২০) বিরত রয়েছেন

যেমন ডিব্রু সাইখোয়া জাতীয় উদ্যানে তৈল উৎপাদনের জন্য পরিবেশ দপ্তরের 

অনুমতি , বা সাম্প্রতিক একই অঞ্চলে বাঘজান তৈলখনিতে আগুন লাগা।




এটা অনস্বীকার্য যে গর্ভবতী হাতির এইরকম বেদনাদায়ক মৃত্যু অত্যন্ত মর্মান্তিক। ১৯৮৬ সাল থেকে এশিয়ান এলিফ্যান্টকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্যা কনসারভেশন অফ নেচার বিপন্ন হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে, প্রজাতির সংখ্যা কমপক্ষে ৫০% হ্রাস পাওয়ার কারণে । তবে সমস্যাটি হল এই মর্মান্তিক ঘটনার রেশ টেনে একটি রাজ্যের বা একটি সমষ্টির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কিছু মানুষ তাদের থেকে সংস্কৃতিগত ভাবে আলাদা অন্য মানুষদের কি চোখে দেখে। এই অপপ্রচারগুলি জেনোফোবিক প্রবণতা পুষ্ট এবং প্রকৃত পরিবেশগত উদ্বেগের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনাবশত হাতির মৃত্যুর খবরগুলিও এই ঘটনার মতোই আকস্মিক এবং মর্মান্তিক। কিন্তু সেই ঘটনাগুলি এতটা প্রচার আকর্ষণ করে না, যা থেকে বোঝা যায় এই ক্ষোভের উদ্দেশ্য নেহাতই পরিবেশপ্রেম বা পশুপ্রেম নয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে হিন্দু মৌলবাদীরা কেরালার হাতির প্রতি নিষ্ঠুরতার গল্পে নৈতিকতার মুখোশ পড়ার চেষ্টায় আছে, যেখানে কেরালার হিন্দু মন্দিরগুলির মালিকানাধীন গৃহপালিত হাতিগুলির দীর্ঘ নির্যাতনের এবং অচলাবস্থার ইতিহাস রয়েছে, যা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।

Comments