#ব্ল্যাক্লাইভজ্‌ম্যাটার ও আমরা


আমেরিকার মিনিয়পোলিস্‌ পুলিশবিভাগের অফিসার ডেরেক শভিনের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের নিষ্ঠুর মৃত্যু ও তাকে কেন্দ্র করে মার্কিনদেশ জুড়ে প্রবল প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমেরিকাব্যপী এই বিক্ষোভকে সামাল দিতে সেদেশের পুলিশ তথা প্রশাসনের শ্ব-দন্ত আত্মপ্রকাশ করেছে। এই ঘটনাপ্রবাহ আমেরিকার জাতীয় রাজনীতিকে ঘিরে আবর্তিত হলেও আন্দোলিত গোটা পৃথিবী, বিশ্বজনজীবনে আমেরিকা কেন্দ্রিকতার এ এক অভূতপূর্ব ফল। তবে বিশ্বজুড়ে এই আলোড়নকে সদর্থক বলেই গণ্য করা যায়। #ব্ল্যাক্লাইভজ্‌ম্যাট্যার এখন বিশ্ব জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে মুখে মুখে। যদিও একই রকম ঘটনা নিরন্তর ঘটে চলেছে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, উগান্ডা এবং আরো জায়গায়, আমাদের চেতনায় তা অপাংক্তেয় থেকে গেছে, আমেরিকা তো নয় সেসব দেশ! আমাদের ভারতবর্ষেও #ব্ল্যাক্লাইভজ্‌ম্যাট্যার-এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও ভাববার সময় এসেছে।

ফেয়ারনেস ক্রিম বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশে ছোট থেকেই বেড়ে ওঠা খবরের কাগজ-টিভিতে ফেয়ারনেস্‌ ক্রীমের বিজ্ঞাপনের ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে। এই বিজ্ঞাপনগুলির লব্জ মোটামুটি একই গতে বাঁধা। শ্যামাঙ্গী-কৃষ্ণকায়া দৈনিক জীবনে হালে পানি পান না, অতএব, (ক্রীমের ব্যবহারে) গৌরাঙ্গী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই মোক্ষলাভ। মোক্ষলাভের স্তরে স্তরে ফর্সা থেকে ফর্সাতর হয়ে ওঠার মধ্যে যেন ষোলকলাপূর্তির উদ্‌যাপন। পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে ‘সুশ্রী’-দাবি প্রকারন্তরে ফর্সামুখেরই দাবি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই ‘বর্ণপ্রীতি’ (ও তদজনিত বর্ণদ্বেষ)-ক্লিষ্ট সমাজের আফ্রিকানিবাসী কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি কী মনোভাব?

পাত্রপাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে দাবিদারহীন পক্ষের ‘সুশ্রী’ পাত্র/পাত্রীর সন্ধান

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যাক। ‘জাতির জনক’ গান্ধীর প্রসঙ্গ উত্থাপন গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রথমভাগে তৎকালীন ইংরেজপ্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার ছত্রছায়ায় তার স্বভাবোচিত দোষগুণে তিনি পুষ্ট। ফলে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দু’ধারার বর্ণবিদ্বেষের ধারক বলা চলে। প্রথমত, ভারতের বর্ণাশ্রমনির্দেশিত তথাকথিত ‘নীচু’-জাতদের প্রতি স্বভাবসিদ্ধ বর্ণদ্বেষ। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীধারা অনুসারী কালাচামড়ার আফ্রিকনদের প্রতি জাতিবিদ্বেষ। গান্ধীর এই দ্বিতীয় সত্তাটির চর্চা বর্তমান ইতিহাসবিদদের কাছে উল্লেখযোগ্য ও আমাদের কাছে দ্রষ্টব্য। রোডেশিয়ান দক্ষিণ আফ্রিকাতে আইনজীবি গান্ধী সেদেশীয় আফ্রিকানদের সম্বোধন করতে বেছে নিয়েছিলেন ইঊরোপিয়ান প্রভুদের ব্যবহৃত বুলি-‘কাফির’, যার অর্থ হল নিঘৃণ্য। অন্যধারে, বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত মুক্তিকামী কালোমানুষদের মসিহারূপে যাঁরা পূজিত হন, যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা বা মার্টিন লুথার কিঙ্‌ জুনিয়ার, তাঁদের চোখে গান্ধী হলেন এক পথপ্রদর্শক আলোকবর্তিকা। গান্ধীর মতবাদকে অনুসরণ করাকালীন গান্ধীর বর্ণবিদ্বেষী মনোবৃত্তি সম্বন্ধে তাঁরা অবগত ছিলেন কিনা বা অবগত থাকা সত্ত্বেও তাঁদের নিজমুক্তিসংগ্রামের পাথেয় হিসেবে গান্ধীর সংগ্রামজীবনের সারগ্রহণ করেছিলেন , তা আমাদের অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু কালের সাথে আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে, সুতরাং তার পুনর্মূল্যায়ন আবশ্যিক। গান্ধীর আফ্রিকা থাকাকালীন কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা-প্রতিবাদ বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরে গান্ধীমূর্তি স্থাপনের ওপরে উঠে আসছে প্রশ্নচিহ্ন

বর্তমানে, ভারতে আফ্রিকার অধিবাসীদের, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের, উপস্থিতি প্রচুর। এবং সেই সাথে তাদের প্রতি ভারতীয়দের বর্ণদ্বেষী মনোভাব প্রবল। একশ’ বছর বা তারও আগেকার আফ্রিকাতে গান্ধীর মনোভাবের সাথে তার বিশেষ ফারাক নেই। নরখাদক, ড্রাগচোরাচালানকারী, দেহব্যবসায়ী, এককথায় বলতে গেলে আফ্রিকান মানেই অপরাধজগতের সঙ্গে যুক্ত-এই স্টিরিওটাইপের শিকার আফ্রিকানরা আমাদের দেশে। ‘হাবসি’, ‘কালা’, ‘কাল্লু’ প্রভৃতি বর্ণবিদ্বেষী অভিধায় তাদের ভূষিত করা তো জলভাত ভারতীয়দের কাছে।

প্রসঙ্গত দ্রষ্টব্য, এই ধরণের আলটপকা বর্ণবিদ্বেষ যে সর্বদা আমাদের জাতক্রোধ থেকে উদ্ভুত তা নয়। অপরাপর জাতিকে হেয়জ্ঞান করা বা অসম্মান করার প্রবণতা আমাদের মজ্জাগত, যার থেকেই এরকম Casual Racism-এর উদ্ভব। বিশেষত, যদি সেই গোষ্ঠী কোন প্রাতিষ্ঠানিক মাপকাঠিতে আমাদের তুলনায় নীচ প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। ২০১৩ সালে, মুম্বাই এফ্‌ সি-র ঘানার ফরওয়ার্ড ইউসিফ্‌ ইয়াকুবু মোহনবাগানের সমর্থকদের বিরূদ্ধে বাঁদরডাক ডাকার অভিযোগ এনেছিলেন, যা বর্ণবিদ্বেষী প্ররোচনা বলে গণ্য করা হয় বিশ্ব জুড়ে। বর্ণবিদ্বেষের এই নিদর্শনটি সত্যিই পরস্পরবিরোধিতার এক আজব নিদর্শন কারণ সেই একই সময় মোহনবাগানের অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন আরেক আফ্রিকান ওডাফা ওকোলি যাঁকে কাঁধে নিয়ে নাচনাচি করতেও পিছপা হতেন না মোহনবাগান সমর্থকরা। ফুটবলপ্রেমীদের স্বভাবসিদ্ধ আবেগপ্রবণতা মাত্রা ছাড়াবে মাঝেমধ্যে, তা অস্বাভাবিক নয়। তবে তা যাতে শিষ্টাচার ছাড়িয়ে মনুষ্যত্ববিরোধী মাত্রা না নেয়, সেই গণ্ডীরচনার দায় আমাদেরই।

বর্ণবিদ্বেষের সবচেয়ে মারাত্মক ফল হল ‘রেশিয়াল্‌ প্রোফাইলিঙ’- যার অর্থ কোন ভিত্তি ছাড়াই বর্ণবিশেষে কিছু প্রবণতার আরোপ করা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ২০১৪ সালে, দিল্লীর তৎকালীন আইনমন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দক্ষিণ দিল্লীর কিছু জনবসতিতে ‘রেইড্‌’ করেন, অভিযোগ-ড্রাগ ও দেহব্যবসার ঘাঁটি নাকি সেইসব জায়গা। এই অভিযান চলাকালীন জনৈক আফ্রিকান মহিলাকে বাধ্য করা হয় জনসমক্ষে তাঁর মূত্রনমুনা দিতে। ২০১৬ সালে বেঙ্গালুরুতে তানজানিয়ার এক মহিলাকে জনসমক্ষে মারধোর করে বিবস্ত্র করা হয় ও তাঁর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে, মারমুখী জনতা নরখাদক অপবাদে গ্রেটার নয়ডা অঞ্চলে আফ্রিকান ছাত্রদের উপর চড়াও হয় যার ফলে একাধিক ছাত্রদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

দিল্লীর প্রাক্তন আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযান চালান আফ্রিকার ছাত্রদের ওপর। এক আফ্রিকান মহিলাকে বাধ্য করা হয় জনসমক্ষে তাঁর মূত্রনমুনা দিতে।

শিল্প জীবনযাত্রারও দর্পণ- এই মত আমাদের দেশেও প্রযোজ্য। ব্ল্যাকফেস্‌, অর্থাৎ অ-কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের মুখ কালো করে কৃষাঙ্গোচিত অঙ্গভঙ্গি করা (মূলত লোক হাসানোর জন্য), সারা পৃথিবীতে, বিশেষত আমেরিকাতে, একটি ঘৃণ্য কাজ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ‘ব্ল্যাকফেস’ খুবই সাধারণ ঘটনা, বিশেষ করে বলিউডে। বিশেষত কমিকরিলিফ্‌ হিসেবে হামেশাই হয়ে থাকে। কিন্তু তার চেয়েও দৃষ্টিকটূ হল, যখন শ্যামবর্ণী ভূমিকায় ‘ব্ল্যাকফেস’ করে অবতীর্ণ হন মূলধারার অভিনেতারা, যাঁরা বাস্তবজীবনে ‘সুশ্রী’, অর্থাৎ গৌরকান্তি এবং কোনভাবেই পর্দার চরিত্রগুলির সাথে তাদের দেহগত সাদৃশ্য থাকেনা। দ্রষ্টব্য, হালের বালা অথবা সুপার্‌ থার্টি। ভারতের শিল্প-সংস্কৃতিজগতের লোকেরাও যখন আফ্রিকানদের তুলে ধরেন তাঁদের কাজে, তখন তাঁদের সেই নন্দনবোধ বা শৈল্পিকচেতনাও প্রায়শয়ই আফ্রিকানদের প্রতি বিদ্বেষদুষ্ট বা অপমানসূচক হয়ে থাকে

‘ব্রাউনফেস’-এ হৃতিক রোশনের অভিনয় সুপার ৩০ সিনেমাতে

প্রবাসেও ভারতীয়রা তাঁদের বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব সরিয়ে রাখতে পারেননা অনেক ক্ষেত্রে। বাদামী-চামড়ার মানুষ হবার সুবাদে পাশ্চাত্যে ভারতীয়রা প্রায়শয়ই আরব বা আফ্রিকার জনজাতি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন ভুলবশত, জোটে দুর্ভোগও। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও নিজেদের মজ্জাগত বর্ণবিদ্বেষকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননা তাঁরা। কৃষ্ণাঙ্গ বা হিস্‌প্যানিক জনজাতিদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও তাদের হেয়জ্ঞান করা প্রবাসী ভারতীয়দের পক্ষে খুবই সাধারণ। ২০১৮ সালে, বিশিষ্ট কম্পিউটারবিজ্ঞানী রোহিত পারিখ সমালোচিত হন ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী কার্যকলাপকে সমর্থন করা ও হিস্প্যানিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করার জন্য।

অনলাইনে প্রবাসী ভারতীয়দের বর্ণবিদ্বেষের নমুনা

পৃথিবী যখন জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে উদ্বেল, তখন ভারতীয় হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য আমাদের সমাজ ও আমাদের মানসিকতার পুনর্মূল্যায়ণ করা, যাতে আমরা আমাদের মজ্জাগত হীনতাকে অতিক্রম করতে পারি।

Comments